বুধবার, ০৮ মে ২০২৪, ০৫:৩২ অপরাহ্ন

ইউপি নির্বাচনে এত প্রাণহানির দায় কার

ইউপি নির্বাচনে এত প্রাণহানির দায় কার

স্বদেশ ডেস্ক:

সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির মাধ্যমে শেষ হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচন। প্রথম ধাপের তুলনায় দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলার চরম অবনতি ঘটেছে। দ্বিতীয় ধাপের ভোটের আগে-পরে শতাধিক প্রাণহানি ঘটেছে বলে নানা মাধ্যমে আলোচনা হচ্ছে। আহত হয়েছেন দুই হাজারের বেশি মানুষ। গতকাল রবিবারও তিন জেলায় সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ২ জনের মৃত্যু ও ৩৬ জন আহত হয়েছেন। এই পরিস্থিতির জন্য ক্ষমতাসীন দলের অস্বচ্ছ মনোনয়ন প্রক্রিয়া, কেন্দ্র ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সমন্বয়হীনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উদাসীনতা এবং নির্বাচন কমিশনের নির্লিপ্ততাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। সংঘাত এড়াতে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছে কিনা, এ নিয়ে সংশয় রয়েছে জনমনেও। স্থানীয় নির্বাচনে উৎসবের আমেজের বদলে প্রাণহানি সৃষ্টির ঘটনায় দায় নিচ্ছে না কেউ। বরং সরকার ও ক্ষমতাসীন দল থেকে বলা হচ্ছে, স্থানীয় নির্বাচনে এমনটা হয়েই থাকে। যদিও নির্বাচন প্রক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা, এ নিয়ে খোদ আওয়ামী লীগের কিছু নেতার মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়া রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত দুই নির্বাচনের অভিজ্ঞতা আমলে নিয়ে পরবর্তী ইউপি নির্বাচনে তা কাজে না লাগালে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে। তবে এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য আগামী ১৯ নভেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক থেকে নির্দেশনা আসবে বলে জানা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে ওই বৈঠক হবে। সেখানে নির্বাচনী সহিংসতার কারণ অনুসন্ধান ও পরবর্তী ধাপের ইউপি নির্বাচনের পরিবেশ সুগম করার বিষয়ে আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশনা আসবে বলে আভাস দিয়েছেন দলের নেতারা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনারসহ একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তির সঙ্গে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের এই ভয়াবহতার চিত্র নিয়ে কথা হয় আমাদের সময়ের। তারা বলছেন, প্রথমত ইউপি নির্বাচন দলীয় প্রতীকে হওয়ায় স্থানীয় নেতৃবৃন্দের মধ্যে দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয়েছে। যারা মনোনয়ন পাওয়ার কথা, তাদের জায়গায় এমন অনেকে মনোনয়ন পেয়েছেন, যারা বিতর্কিত, অনুপ্রবেশকারী ও নানা অপরাধে জড়িত।

অপরদিকে ত্যাগীরা মনোনয়ন না পেয়ে ফুঁসে ওঠেন। নাম লেখান ‘বিদ্রোহী তালিকায়’। স্বতন্ত্র প্রার্থীর মোড়কে নির্বাচন করলেও দ্বন্দ্ব থেমে থাকে না মূল প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে। আর এই দ্বন্দ্ব রূপ নেয় প্রাণঘাতী সহিংসতায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে দল এ বিষয়ে আরও সর্তক হলে এত প্রাণহানি ঘটত না। পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলেও স্থানীয় প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশন ছিল উদাসীন। নির্বাচন ঘিরে প্রচুর অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে। এসব অস্ত্র উদ্ধারের জন্যও তেমন অভিযান দেখা যায়নি।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনকে দেখা হচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের শেষ পরীক্ষা হিসেবে। এই কমিশন এখন পর্যন্ত একটি নির্বাচনও সুষ্ঠু করতে পারেনি বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। সামনের ধাপগুলোতে যেন ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন সুষ্ঠু হয়, সেজন্য নির্বাচন কমিশনসহ সবার প্রতি আহ্বান জানান তারা।

প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার বিষয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব) আবদুর রশীদ আমাদের সময়কে বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপের ইউপি নির্বাচনে অনেক স্বতন্ত্র প্রার্থী পাস করেছেন। প্রশাসন দলীয় প্রার্থীর পক্ষে থাকলে হয়তো এমন পরিস্থিতি হতো না। এতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বও দেখা যায়নি।’ তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় কাজ করে। এর মধ্যে একটা হলো স্থানীয় পরিবেশ। যেসব এলাকায় নির্বাচনী পরিবেশের অভাব ছিল, তা আগে থেকেই আমলে নিলে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে প্রশ্ন দলেই জন্ম নিয়েছে।

দ্বিতীয় ধাপের নির্বাচনে অনেক বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। এতে প্রমাণ হয় যে জনপ্রিয় নন, এমন অনেকে মনোনয়ন পেয়েছেন। যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করেন, অর্থাৎ স্থানীয় সংসদ সদস্য, স্থানীয় নেতা এবং কেন্দ্র থেকে যিনি সমন্বয় করেন, তারা যদি তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতেন, তাহলে এই দ্বন্দ্ব কিছুটা হলেও নিরসন হতো। অনেক ক্ষেত্রেই সহিংসতা এড়ানো সম্ভব ছিল। নির্বাচন কমিশন এককভাবে সহিংসতা এড়াতে পারবে, এমনটি আমি মনে করি না।’

এ ব্যাপারে স্থানীয় সরকার বিভাগের সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘এবার যেহেতু বিএনপি অংশ নিচ্ছে না, তাই তাদের সেভাবে দায়ী করা যাচ্ছে না। কিন্তু নিজ দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে না পারার দায় আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই এড়াতে পারে না। অন্যদিকে যে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করতে সহযোগিতা করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারেও আওয়ামী লীগ আছে। সুতরাং এখানেও তারা দায় এড়াতে পারবে না। এর বাইরে নির্বাচন কমিশনেরও দায় আছে। আমাদের নির্বাচন কমিশন স্বাধীন সার্বভৌম কমিশন। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান, আইন ও বিধিবিধান অনেকভাবে ক্ষমতায়ন করেছে। কিন্তু অর্পিত পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, তারা তা নিতে পারছে না। এখানে তারা ব্যর্থ। মোদ্দা কথা হলো- এ সংঘাত, বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির দায় নির্বাচন কমিশন, সরকার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে নিতে হবে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য আমাদের সময়কে বলেন, ‘এই পরিস্থিতির দায় আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে। প্রার্থী নির্ধারণে আরও বেশি গুরুত্ব দেওয়া এবং নির্বাচনে দলীয় প্রতীক উঠিয়ে উন্মুক্ত প্রার্থী দিলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।’ তিনি বলেন, ‘আমার যদি ক্ষমতা থাকত, তাহলে আজ থেকে স্থানীয় নির্বাচন উন্মুক্ত করে দিতাম।’

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পীযূষ কান্তি ভট্টাচার্য্য আমাদের সময়কে বলেন, ‘নির্বাচনে এ রকম পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমার মনে হয়, মনোনয়নের পর নেত্রী শেখ হাসিনা দেশে না থাকায় বিষয়টি তদারকির কেউ ছিলেন না। এখন তিনি দেশে এসেছেন। আমার মনে হয় পরবর্তী সময়ে এমনটা হবে না।’

নির্বাচন কমিশন সচিব মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির খন্দকার বলেছেন, ‘স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রভাব বিস্তারের ঘটনা ঘটেছে। যে ঘটনা ঘটেছে, তা যেন পরের নির্বাচনে না ঘটে সেদিকে নজর রাখা হবে।’

নির্বাচনে সংঘর্ষ ও সংঘাতের বিষয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, ‘আমাদের বিশাল এলাকা নিয়ে নির্বাচন হচ্ছে। এই ইউপি নির্বাচন এটা সবসময় আপনারা দেখে আসছেন, এটা গোষ্ঠী-গোষ্ঠীর নির্বাচন, আধিপত্যের নির্বাচন, এখানে সবসময়ই একটু ঝগড়াঝাটি হয়েই থাকে।’

এদিকে গতকালও পটুয়াখালীর গলাচিপা ও গাইবান্ধায় নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় আহত ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল নির্বাচনী সহিংসতা হয়েছে আরও তিন এলাকা- সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, চাঁদপুরের মতলব উত্তর ও মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায়। এসব ঘটনায় আহত হয়েছেন ৩৬ জন।

আমাদের সময়ের নিজস্ব প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর-

গলাচিপা (পটুয়াখালী) : গলাচিপায় ইউপি নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতায় আহত একজন ঢাকার একটি হাসপাতালে গত শনিবার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনি গলাচিপা সদর ইউপির ৭ নম্বর ওয়ার্ডের হামিদ পল্লানের ছেলে দুদা পল্লান।

গত ১১ নভেম্বর নির্বাচনে মেম্বার হিসাবে বিজয়ী হন নাজিউর রহমান মঞ্জু। কিন্তু তার পক্ষে কাজ না করায় ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় মঞ্জু ও তার বড় ভাই মো. নেছারের নেতৃত্বে একদল সমর্থক মো. দুদা পল্লানের ওপর হামলা চালায়। দায়ের কোপে মাথার বাম পাশে গুরুতর আঘাত পান তিনি।

মতলব উত্তর (চাঁদপুর) : ফতেপুর পূর্ব ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী নুরুল ইসলাম পাটোয়ারীর ওপর নৌকার প্রার্থী আজমল হোসেন চৌধুরীর সমর্থকরা হামলা চালায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নির্বাচনী প্রচারের সময় উপজেলার সাহেব বাজারে এ ঘটনা ঘটে। হামলায় নুরুল ইসলামের মাথা ফেটে যায়। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।

উল্লাপাড়া (সিরাজগঞ্জ) : উল্লাপাড়ায় স্বতন্ত্র ও আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. আলামিন সরকারের নির্বাচনী অফিস ভাঙচুর এবং ১৫ নেতাকর্মীকে মারধরের অভিযোগ উঠেছে। গতকাল দুপুরে  উল্লাপাড়া উপজেলার পূর্ণিমাগাঁতী ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের পুকুরপাড় গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।

গাইবান্ধা : নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় আহত হামিদুল হক গতকাল সকালে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। গত ১১ নভেম্বর রাতে সদর উপজেলার বল্লমঝাড় ইউনিয়নের দক্ষিণ ধানঘড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে সহিংসতায় তিনি আহত হয়েছিলেন। হামিদুল বল্লমঝাড় ইউনিয়নের দক্ষিণ ধানঘড়া গ্রামের আবু সরকারের ছেলে। তিনি স্বর্ণালঙ্কার দোকানের কর্মচারী ছিলেন।

মুন্সীগঞ্জ : সদর উপজেলার মোল্লাকান্দি ইউপি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। গতকাল সকাল থেকে দফায় দফায় এই সংঘর্ষ হয়। এতে উভয়পক্ষের কমপক্ষে ২০ জন আহত হন।

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877